শিরোনাম
◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা ◈ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত

প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:৪১ সকাল
আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:৪১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্যালুট, ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীক

অজয় দাশগুপ্ত : দেখা না হলেও এদেশে আসার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আমার। একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক। আজ যার জন্মদিন। ওডারল্যান্ড মূলত ডাচ পরে অষ্ট্রেলিয়ান। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশে ছিলেন বাটার বড় কর্মকর্তার পদে। টঙ্গীতে চাকরিরত এই মানুষটির জীবন কৌতুহলময়। তথ্য বলছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে চলাচলের সুযোগ ছিল তার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে হত্যা-নির্যাতনের ছবি তুলে সে সব ছবি গোপনে বিদেশের গণমাধ্যমে পাঠাতে থাকেন। সেই সঙ্গে চেষ্টা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ সৃষ্টির।

একটা পর্যায়ে তিনি গভর্নর লে. জে. টিক্কা খান ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. নিয়াজি, রাও ফরমান আলীসহ পাকিস্তানি সেনাদের মাথা-মুরব্বিদের সঙ্গে দহরম-মহরম গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে তাদের অনেক গোপন পরিকল্পনা, নানা ধরনের সমর তথ্য জানার সুযোগ হয় তার। ওডারল্যান্ড সে সব তথ্য নিয়মিত পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টরের মেজর এ টি এম হায়দারদের কাছে। সমর তথ্য সংগ্রহের কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করছিলেন তিনি, যেমন করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনা শিবিরে গিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ওডারল্যান্ডের পিতৃভূমি হলেও ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তার জন্ম হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে। জীবিকার তাগিদে ১৭ বছর বয়সে তিনি একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, পরে সেখান থেকে বাটা সু কোম্পানিতে।

জার্মানির নাৎসি বাহিনী হল্যান্ড আক্রমণ করলে তিনি ডাচ সেনাবাহিনীতে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দেন। নাৎসিরা ১৯৪০ সালে বিমান হামলায় হল্যান্ডের রটারডাম শহর বিধ্বস্ত করে দেয়, হল্যান্ড চলে যায় তাদের দখলে। ওডারল্যান্ড বন্দি হন জার্মানদের হাতে। তবে কৌশলে তিনি বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধফেরত সৈনিকদের ক্যাম্পে কাজ করতে থাকেন। যোগ দেন ডাচ-প্রতিরোধ আন্দোলনে। ডাচদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জার্মান ভাষা রপ্ত ছিল তার। এই সুযোগ নিয়ে তিনি জার্মানদের গোপন আস্তানায় ঢুকে পড়েন। তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাতে থাকেন মিত্রবাহিনীর কাছে। ১৯৪৩ সালে তিনি কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কমান্ডো সৈনিক ওডারল্যান্ড এই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়েছেন ঢাকায় নানাভাবে। প্রথম পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করলেও শুধু এতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা তাকে এতটাই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল যে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। টঙ্গীর বাটা কারখানার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষণ শিবির।

কমান্ডো হিসেবে অস্ত্র, গোলাবারুদ সম্পর্কে তার পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল। নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় গেরিলা যুদ্ধ চালান। ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করেন, রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। যুদ্ধের পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদের নগদ অর্থ, খাদ্য ও কাপড়চোপড় দিয়ে নানাভাবে সহায়তা করেছেন।
ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হতে গিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। তার একটি ছবিতে দেখা যায় রাইফেল উঁচিয়ে কিভাবে যোদ্ধার মতো আমাদের জয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। ঠিক যেন কোনো বাংলাদেশি। এসব কাজে তার ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি। পাকিরা তাকে সন্দেহ করতেও কসুর করেনি। তারপরও তিনি থামেননি। দেশমুক্তির ব্যাপারে তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। এমনকি ইতিহাসের বেলায়ও তাকে মনে রাখতে হবে। স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় যখন জাতির জনকের হত্যা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি তিনি। শ্রুত যে এ নিয়ে উল্লাসরত কর্মচারিকে বাটা থেকে বরখাস্ত করেছিলেন এই বীরপ্রতীক।

এ ছাড়াও তিনি তার সম্মাননা গ্রহণের বিষয়েও ছিলেন দোটানায়। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এ স্বীকৃতি কতটা দরকারি এমন ভাবনা হয়তো কাজ করেছিল তার ভেতর। কর্ণেল ওসমানীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুরাগ আর বাংলাদেশকে ভালোবাসার কারণে তিনি গেলেও তার মনে শান্তি ছিল না। যে একবার তার কথা শুনেছি তখনই তা টের পেয়েছি। যে দেশের নাম শুনলে তিনি জ্বলে উঠতেন ভালোবাসায়, তার মন হয়ে উঠত আবেগকাতর সে দেশের ইতিহাসও এমন পরিণতি তিনি মানতে পারতেন না। এই কথা আমি ‘মেলবোর্ন এইজ’ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুস উইলসনের মুখেও শুনেছিলাম। তিনিও ছিলেন ১৬ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় তখনকার রেসকোর্স ময়দানে। আমাদের বদলে যাওয়া সহ্য করতে না পারা এই মানুষেরা ছিলেন একাত্তরের বীর সেনানী।

ওডারল্যান্ড ও তার পরিবারের প্রতি আমাদের ভালোবাসার যেন কমতি না হয়। এই মানুষটি সারাজীবন একজন বীরপ্রতীক হিসেবে বেঁচেছেন। একবার ভাবুন একজন অচেনা অজানা বিদেশি মানুষ আমাদের কষ্টে দুঃখে বিচলিত হয়ে আমাদের জন্য অস্ত্র হতে তুলে নিয়েছিলেন। আর সে গৌরব তিনি আমরণ বহন করেছেন মমতায়। আমাদের এখানে এক আয়োজনে এসেছিলেন তার একমাত্র সন্তান কন্যা এ্যানি হ্যামিলটন। যিনি পিতার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে গর্বিত। দুর্ভাগ্য আজকের প্রজন্ম এদের চেনে না। বিজয়ের মাস বলে আমরা যত আবেগ আর উত্তেজনায় ভুগি না কেন এই সব মানুষদের চেনানোর কাজ হয় না। এটা নিশ্চিত যে কোনো দেশে এমন বিদেশি বীরকে মাথায় তুলে রাখত। আমরা তার নামে ঢাকায় একটা সড়ক করেছি মাত্র। রাখিনি বুকের মণিকোঠায়। তা যদি না হয় ইতিহাস বিকৃতি আর মিথ্যা তো চলতেই থাকবে।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়