টাকার বিপরীতের ডলারের মূল্য চড়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপেও এ বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিশ্বব্যাপী যেখানে ডলারের দাম পড়তির দিকে সেখানে বাংলাদেশে ভিন্ন চিত্র। রপ্তানি কম হওয়া এবং রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়ার কারণে ডলারের দাম বাড়ছে। ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিকারকরা লাভবান হন আর ক্ষতিগ্রস্ত হন আমদানিকারকরা।
আমদানিকৃত পণ্যমূল্য পরিশোধ বা বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেবা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতেই বিনিময় হার নির্ধারিত হয়। মুদ্রার বিনিময় হার সাধারণত দুইভাবে করা হয়। নমিনাল বিনিময় হার এবং প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার। এক মুদ্রার বিপরীতে অন্য মুদ্রা যত পাওয়া যায় তাই নমিনাল বিনিময় হার। অন্যদিকে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হারের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় দুই টাকা। আর এক বছর আগের চেয়ে এখন বেড়েছে প্রায় চার টাকা। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার এখন ৮২ টাকা ৩০ পয়সা। জুন শেষে যা ছিল ৮০ টাকা ৬০ পয়সা। আর গত মার্চে ছিল ৭৯ টাকা ৬৮ পয়সা। আর জুন ২০১৭ শেষে টাকা-ডলার বিনিময় হার পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় দুই দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালের জুন শেষে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরো বেশি।
ডলার বাজারের এমন পরিস্থিতিতে ঘোষিত বিনিময় হার মেনে না চলায় সম্প্রতি ২৬ ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর তাদের জবাব যদি সন্তোষজনক না হয় তাহলে ব্যাংক কোম্পানির নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনি ডলার ছাড়ছে। তবে তাতে খুব বেশি ফলাফল আসছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স একটি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হিসেবে বিবেচিত। আর আমদানির দায় মেটাতে ডলার ব্যয় করতে হয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পুরোটাই ধারণ করেতে পারে না ব্যাংক। ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রাখতে পারে কোন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত এ সীমা মেনে বৈদেশিক মুদ্রা ধারণ করতে হয়। যখন কোন ব্যাংকে সীমার অতিরিক্ত ডলার হয়ে যায় তখন অন্য ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তা বিক্রি করে দেয় ওই ব্যাংক। মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে ডলার ক্রয় বিক্রয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গেল অর্থবছরের এপ্রিল-জুন এ তিনমাসে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ১২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার বিক্রয় করে। তবে এসময়ে কোন ডলার কেনেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ কোটি ডলার বিক্রয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভিন্ন চিত্র ছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজার থেকে মোট ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল। আর বিক্রি করেছিল মাত্র ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রপ্তানি ধীরগতিতে এগুচ্ছে। রপ্তানির চেয়ে প্রবাসী আয়ে আরও খারাপ অবস্থা যাচ্ছিল। তবে গত দুই মাসে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। অন্যদিকে বাড়ছে আমদানি আয়। দেশে চালের সঙ্কট থাকায় আমদানি ব্যয় বেশি বেড়েছে। এর পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও ব্যয় বাড়াচ্ছে।
এমন অবস্থার কারণে মূলত ডলারের চাহিদা বাড়ছে। তবে দেশে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, এখন প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার বা তিন হাজার ৪৫ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে ৯ মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদ্ল অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। ইত্তেফাক।
আপনার মতামত লিখুন :