শিরোনাম
◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:৫১ সকাল
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:৫১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টায় মিয়ানমার

রাহাত : তিনি কলেজ জীবনে রোহিঙ্গা ছাত্র সংগঠনের একজন সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্টে এক আসনে জয় লাভ করেছিলেন। তিনি একজন রোহিঙ্গা। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মতে, ইউ কিয়াও মিনের মতো রোহিঙ্গাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যে বহুদিন ধরে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।

বর্তমানে এই জাতিগোষ্ঠীর বেশিরভাগ জনসংখ্যাই দেশহীন অবস্থায় দিন যাপন করছে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি পর্যন্ত দিচ্ছে না। রাখাইনের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ইউ কিয়াও সান হ্লা বলেন, রোহিঙ্গা বলতে কিছু নেই। এটা ভুয়া খবর। তার এরকম অস্বীকৃতিতে হতবাক কিয়াও মিন। তিনি ৭২ বছর ধরে মিয়ানমারে বাস করছেন। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাস এরও কয়েক প্রজন্ম আগ থেকে শুরু। মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলছে, রাখাইনে আগস্টে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাখাইনে সামরিক বাহিনীর ওই অভিযানকে জাতি নিধন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার অক্টোবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী কার্যকরীভাবে মিয়ানমারের ভূখণ্ড থেকে রোহিঙ্গাদের সকল চিহ্ন ও স্মৃতি এমনভাবে মুছে ফেলার জন্য কাজ করছে যাতে করে রোহিঙ্গারা যদি কখনো সেখানে ফিরে যায় তাহলে তারা শুধু একটি শূন্য ও অপরিচিত ভূখণ্ড ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। ইয়াঙ্গুন নিবাসী কিয়াও মিন বলেন, আমাদের দেশে রোহিঙ্গারা শেষ। খুব শিগগিরই, আমরা হয়তো মারা যাবো, নয়তো হারিয়ে যাবো। জাতিসংঘের প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, রাখাইনে সামরিক বাহিনী তাদের অভিযানে- শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের টার্গেট করেছে- যাতে করে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস , সংস্কৃতি ও জ্ঞান মুছে ফেলা যায়। ইউ কিয়াও হ্লা অং একজন রোহিঙ্গা আইনজীবী ও সাবেক রাজনৈতিক বন্দি(পলিটিক্যাল প্রিজনার)। তার বাবা রাখাইনের রাজধানী সিত্তুয়ির এক আদালতে একজন কেরানির কাজ করতেন। তিনি বলেন, আমাদের (রোহিঙ্গা) নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। তারা (মিয়ানমার সরকার) কিভাবে এমন আচরণ করতে পারে যে, আমরা কিছুই না? কিয়াও হ্লা অং পূর্বে বহুবার তার কর্মের জন্য জেল খেটেছেন। বর্তমানে তার নিবাস সিত্তুয়ির একটি শিবির।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি জানান যে, তার পরিবার খাওয়ার মতো যথেষ্ট খাদ্য পাচ্ছে না। কারণ, সরকার সেখানে আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের ওই হঠাৎ উদয় হওয়া স্মৃতিভ্রম যেমন সাহসী তেমনি পদ্ধতিগতও। পাঁচ বছর আগে, সিত্তুয়ি ছিল একটি মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের শহর। এর মাঝে বৌদ্ধরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ আর রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু। কিন্তু ২০১২ সালে সেখানে নতুন করে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। খুব দ্রুতই রোহিঙ্গারা ওই দাঙ্গার নৃশংসতার শিকার হয়। কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। পুরো শহরে এখন মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় নেই। পুরো রাখাইন জুড়ে বর্তমানে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। সেখানে প্রায় সবাইকে শিবিরে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এমনকি যাদের নাগরিকত্ব রয়েছে তাদেরও। কর্মকর্তাদের অনুমতি ব্যতীত কুটির থেকে বের হওয়া নিষেধ তাদের। সিত্তুয়ির আবহাওয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। পূর্বে এই শহর জুড়ে রোহিঙ্গাদের দোকানপাট ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এখন কোনো রোহিঙ্গাই এ বিষয় স্বীকার করতে চায় না। সিত্তুয়ি ইউনিভার্সিটিতে এক সময় হাজার হাজার মুসলিম শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হতো। এখন সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩০ জনের কাছাকাছি। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ইউ সুয়ে খাইং কিয়াও বলেন, আমাদের এখানে কোনো ধর্ম ভিত্তিক বিধি-নিষেধ নেই। কিন্তু তারা এখানে আসতে চায় না। কিয়াও মিন এক সময় সিত্তুয়িতে শিক্ষকতা করতেন। তার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ছিল বৌদ্ধ-ধর্মালম্বীর। তিনি জানান, আজকাল তার বৌদ্ধ-সহকর্মী, শিক্ষার্থীরাও তার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা বোধ করে। তিনি বলেন, তারা চায় যাতে করে কোনো আলাপ যত দ্রুত সম্ভব শেষ হয়ে যাক।

কারণ তারা এটা ভাবতে চায় না যে, আমি কে বা আমি কোথা থেকে এসেছি। কিয়াও মিন ১৯৯০ সালে এক জাতীয় নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ডেমোক্রেসির সঙ্গে সংযুক্ত একটি রোহিঙ্গা দলের হয়ে পার্লামেন্টে এক আসনে জয়লাভ করেন। কিন্তু দেশটির তৎকালীন সামরিক জান্তারা ওই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কিয়াও মিনকে খাটতে হয় জেল। ঔপনেবেশিক আমলে, বৃটিশরা দক্ষিণ এশীয় ধান চাষি, ব্যবসায়ী ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বার্মায় (মিয়ানমার) অভিবাসন করতে উৎসাহিত করেছিল। ওইসব অভিবাসনকারীদের অনেকে ঐখানকার তৎকালীন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যায়। তারা সাধারণত আর্কানি ইন্ডিয়ানস বা আর্কানি মুসলিম হিসেবে পরিচিত। ১৯৩০ সালের মধ্যে ইয়াঙ্গুনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা হয়ে ওঠে দক্ষিণ এশীয়রা- হিন্দু ও মুসলিম উভয়ে মিলে। কিছু বৌদ্ধের মনে হতে থাকে তাদেরকে দক্ষিণ এশীয়রা ঘেরাও করে রেখেছে। জেনারেল নে উইনের প্রায় অর্ধশতক ধরে চলা ‘জেনোফোবিক ’(বিদেশীদের প্রতি ভীতিমূলক) শাসনামলে লাখ লাখ দক্ষিণ এশীয় প্রাণভয়ে মিয়ানমার থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাখাইনে মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে দাঙ্গা সহিংস রূপ নেয়া শুরু করে। বৌদ্ধরা সমর্থন করতো এক্সিস’দের ও মুসলিমরা সমর্থন করতো জোটকে। পরবর্তীতে একদল রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আবির্ভাব ঘটে। তারা রাখাইনকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) অংশ বানানোর চেষ্টা চালায়। এতে সম্পর্কের টানাপড়েন আরো গভীর হয়।

১৯৮০ সালের মধ্যে সামরিক জান্তারা বেশিরভাগ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। নির্মম সামরিক অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দলে দলে মিয়ানমার ছাড়ে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের সময় সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি অভিজাত শ্রেণির বেশ প্রভাব বিদ্যমান ছিল। মিয়ানমারের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে একটি রোহিঙ্গা ছাত্র সংগঠন গঠন করার মতো যথেষ্ট রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ছিল। দেশটির প্রথম স্বাধীনতা পরবর্তী নেতা ইউ নু, তার প্রশাসনে একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ দেন- যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন একজন আরকানি মুসলিম হিসেবে। এমনকি জেনারেল নে উইনের আমলেও মিয়ানমারের জাতীয় রেডিও সমপ্রচার হতো রোহিঙ্গাদের ভাষায়।

তৎকালীন পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল- এমনকি রোহিঙ্গা নারীদেরও। রাখাইনের বুথিডং পৌরসভার নিবাসী ইউ সুয়ে মং ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি দল ইউনিয়ন সোলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পারড়টির একজন সদস্য ছিলেন। তবে ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাকে লড়তে দেয়া হয়নি। এই নির্বাচনে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ভোট দিতে হয়নি। সুয়ে মং’য়ের নির্বাচনী জেলার মট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে একজন বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী নেতা। সেপ্টেম্বরে একজন স্থানীয় পুলিশ কর্মী সুয়ে’র বিরুদ্ধে একটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী মামলা করে।

মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে দেয়া তার এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি সহিংসতা উস্কে দিচ্ছেন। সুয়ে মং নিজে একজন পুলিশ কর্মীর সন্তান। বর্তমান তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত হয়ে দিনাতিপাত করছেন ও তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, তারা সব রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী বা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করতে চায়। মানবজমিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়