শিরোনাম
◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:২১ সকাল
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৬:২১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

উন্নতির মধ্যেও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ

আবুল মোমেন : আগামী নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা খুব একটা চাপা নেই। বর্তমান সরকার যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, তার প্রমাণ অবশ্যই জনগণ পাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের আগের মেয়াদেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং জেল হত্যাকারীদের বিচার ও প্রধান অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। তখনই সংবিধান থেকে কুখ্যাত দায়মুক্তির বিধান বাতিল করা হয়েছিল। এই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করে মূল অপরাধীদের রায়ও কার্যকর করেছে। অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদা পাওয়ায় সরকারিভাবে তা ব্যাপকভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হয়েছে।

নিন্দুক অবশ্য প্রশ্ন তুলতে পারে যে এসবের সঙ্গে চেতনার সম্পর্ক কতটা? ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত যেসব সরকারকে আমরা দেখেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যাবে যে ওপরে বর্ণিত বিচারের কাজগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আরব্ধ ছিল। তা সম্পন্ন করে বর্তমান সরকার সেসব বাধা দূর করেছে।

কিন্তু নানা ঘটনায় এবং সরকারের অনেক পদক্ষেপে সচেতন মানুষ শঙ্কার সঙ্গে লক্ষ করছে যে দেশ ক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সমাজে সাধারণভাবে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বাড়ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদী নানা সংগঠনের সাম্প্রদায়িক দাবিদাওয়ার প্রতি সরকার নমনীয় এবং এসব সংগঠনের সঙ্গে আপস করে চলছে—যদিও সবাই জানি এসব সংগঠন ও তাদের দাবিগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। দেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বেড়েছে, যা পাঠ্যবই ও শিক্ষা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। বলা দরকার, এ ধরনের কাজ পাকিস্তান সরকার চেষ্টা করেও এ দেশে জায়মান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বর্তমানে সমাজে যেসব প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক চেতনার সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চলে, তাতে আওয়ামী লীগ বা তাদের অঙ্গসংগঠন ও তাদের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। বিপরীতে তাদের ঘনিষ্ঠতা দেখা যায় ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের সঙ্গে। হয়তো মনে করিয়ে দিতে হবে না, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান এবং গুরুত্ব লাভের ঘটনা কী পরিমাণ ঘটছে সেসব কথা।

মাঠপর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অর্থোপার্জন ও ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে দৃশ্যমানভাবেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে কয়েক বছর ধরে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এসব ঘটনায় গত কয়েক বছরে কেবল ছাত্রলীগেরই কয়েক ডজন নেতা–কর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। আশঙ্কা হয়, সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে এই অন্তর্দলীয় ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র আকার ধারণ করবে এবং আরও মৃত্যুর কারণ ঘটাবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, নানা উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে বিভোর সরকার এসব নিয়ে বিব্রত বা খুব ভাবিত এমনটা মনে হয় না। গত প্রায় আট-নয় বছর এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। পঁচাত্তরে ক্ষমতা হারানোর পরে বৈরী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অল্প কিছু নেতা দল পরিবর্তন বা রাজনীতি ছেড়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তান আমলের মতোই মূলত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভূমিকা ও নেতৃত্বেই স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয়ে গণতন্ত্রের বাতাবরণ উন্মুক্ত হয়েছিল। যদিও পাকিস্তানি আমলের মতোই এই আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতি এবং প্রগতিশীল বাম রাজনীতিরও একটা কার্যকর ভূমিকা ছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে আসার পরে বা বলা যায়, সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হওয়ার পর থেকে দেশে রাজনীতির দ্রুত অবক্ষয় ঘটতে শুরু করল। ঠিক এই সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয় এবং তখন থেকে ক্রমান্বয়ে বাম ধারার রাজনীতিও সংকুচিত হয়ে এসেছে।

বিপরীতে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি মিলিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই বাস্তবতায় উন্নয়নশীল একটি দেশ যখন বাজার অর্থনীতির নেশায় মেতে ওঠে, তখন তার রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবন রাজনীতির আদর্শিক বন্ধনগুলো হারিয়ে ফেলতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকটগুলো নানা রূপে ও নানা মাত্রায় কীভাবে লালিত হয়, কেন ও কীভাবে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটল কিংবা রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও ভারতের ভূমিকা কেন তার প্রতিকূলে যায়, সেই রাজনীতির চর্চা যেন আজ আওয়ামী লীগে নিষিদ্ধ বিষয়। এর মানবিক সংকট কিংবা অর্থনৈতিক দায়, বড়জোর সামাজিক অভিঘাত নিয়ে ভাবা হয়, কিন্তু এসবের পেছনের রাজনীতি যদি আলোচনায় বাদ পড়ে যায়, তবে কখনো এ ধরনের সমস্যার সমাধান হবে না বরং সমস্যা আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়বে।

আর দেশের সমস্যার গভীরতা এখানেই যে অজস্র রাজনৈতিক টক শো, গোলটেবিল, সভা-সমিতি, বক্তৃতা এবং লাখ লাখ রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক কালে সমাজের যতটা সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে, ততটাই হয়েছে বিরাজনৈতিকীকরণ। রাজনীতিবিদেরা এখন ব্যবসা করেন, সামাজিক শক্তি বাড়ান, মাস্তান পোষেন এবং কোন্দল লালন করেন; কিন্তু সদর্থে রাজনীতি করেন না। আর এই অঙ্গনের বাকি সব ফ্রন্ট বড় রাজনৈতিক দলের লেজুড়ে পরিণত হওয়ায় তাদেরও অর্থবিত্তের স্বার্থ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।

বাজার অর্থনীতির নানামুখী প্রভাব নাগরিক সমাজের ওপরও পড়েছে, তাঁদের সামাজিক ও রাজনীতিসচেতন উদ্যোগগুলো নিজেদের বলয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গণ্ডি পেরোতে পারে না। কারণ এমন কোনো পেশাজীবী বা ছাত্র-তরুণ সংগঠন নেই, যারা নতুন কোনো তথ্য বা তত্ত্বকে গণমানুষের কাছে নিয়ে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করতে পারে। গোলটেবিল আর টিভির টক শোর মধ্যে এসব কার্যক্রম বন্দী হয়ে আছে। দেখা যায় টিআইবি, আইন ও সালিস কেন্দ্র, সিপিডি বা অন্য যারাই দেশের বিরাজমান আর্থসামাজিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলে, বড় দুই দলই কার্যত তাদের প্রতি রুষ্ট হয়, বৈরী থাকে।

বাংলাদেশের যেসব মানুষের মনে ও স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস ও চেতনা এখনো জাগ্রত, তাঁরা আজ কেবল হতাশায় নয়, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর আশঙ্কায় ভুগছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে, আর্থসামাজিক উন্নতি ঘটবে, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক আনন্দদায়ক খবর। কিন্তু এই একই সময়ে যদি দেশ রাজনীতিহীন হয়ে পড়ে, তাহলে কার অ্যাজেন্ডা পূরণ হচ্ছে? রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলেন এক স্বৈরশাসক আর আজ তালেগোলে পড়ে দেশ এই সময়ে রাজনীতিহীন হয়ে পড়ছে।

কেবল দেশ নয়, আপনি দেশের আনাচে-কানাচে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের একটু সচেতন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সামান্য কথা বললেই তাঁদের কণ্ঠে হতাশার কথা শুনবেন। তাঁদের হতাশার মূল কারণ কেবল জামায়াত-বিএনপি থেকে হায়ারে খেলতে আসা নেতা-কর্মীদের বাড়বাড়ন্ত নয়, অর্থাৎ মনের কোনো ঈর্ষা নয়, বরং তাঁরা রাজনৈতিক এলিমেন্ট বলেই বর্তমান অবস্থায় হতাশা চাপতে পারছেন না, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ গোপন করছেন না। ক্ষমতা-বিত্তের প্রতিপত্তি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনোখুনি ও জাঁকজমকের আড়ালে এই হতাশার কথা শোনারও কেউ নেই বর্তমান আওয়ামী লীগে।

যাঁরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশকে লালন করেছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ করেননি, তাঁরা অনেকেই রাজনীতিও করেননি, নানাভাবে সাহিত্য-শিল্পের চর্চা, শিক্ষকতা-সাংবাদিকতা, সমাজকর্ম-সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে এক লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। তাঁরা সবাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। সবাই ৭ মার্চের ভাষণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বস্তুতপক্ষে, এই ভাষণের সময় কেবল এ ধরনের মানুষ নন, মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর ছাড়া সব বাঙালি এক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সেই সময় দেশ ও মানুষের কল্যাণকে নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা-ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। চেতনার সেই মালিকানায় উজ্জ্বল হয়ে সৌরভ বিস্তার করেছে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা সব মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির ফুল। এর মধ্যে সোজা কথায়, কোনোটিই বিনিময়যোগ্য নয়। সব কটিই অপরিহার্য। অর্থনৈতিক মুক্তি যদি গণতন্ত্র বা অসাম্প্রদায়িকতার বিনিময়ে আসে, তাহলে সেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ হবে না।

বেদনা এখানেই যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফুলঝুরি ছড়ালেও বাস্তবে চেতনার দিক থেকে দেশ চলেছে বিপরীতে। তার দায় কীভাবে এড়াবে আওয়ামী লীগ?

শুরুতে নির্বাচনের কথা বলেছিলাম, ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার কথাও তুলেছি। সেটা এ কারণে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের সামনে অন্য কোনো বিকল্পও নেই। এটাও কি আওয়ামী লীগের রাজনীতিহীনতা, বিপরীত চেতনার সঙ্গে আপসকামিতা এবং চেতনার বিনিময়ে অর্থনৈতিক উন্নতির ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না?

সময় দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়