কাকন রেজা : ‘কুবের’ বাস্তবের মানুষ। আমরা কুবেরদের দেখতে পাই আশে পাশেই। পদ্মা নদীর বাস্তবতা থেকে বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে ‘কুবের’। এই উঠে আসা খুব কঠিন সাধ্য নয়। তৈরি চরিত্রকে হাত যশে রূপ দেওয়া অনেকটা হাত সাফাইয়ের মতো। এমনিতে চোখে পড়ে না, কিন্তু মুদ্রিত অক্ষরে দৃষ্টি কাড়ে। কিন্তু একটি চরিত্র সৃষ্টি করে তাকে বইয়ের পাতা থেকে পথে নামিয়ে দেওয়া কোনো আয়াস সাধ্য কাজ নয়।
এমন দুষ্কর কর্মটি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। বইয়ের পাতা থেকে ‘হিমু’দের পথে নামিয়ে দিয়েছেন, ‘হিমু’রা পথে নেমে এসেছে।
যারা হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনা করেন। তার লেখা কে বলেন ‘সস্তা’। তার লোক প্রিয়তাকে ব্যঙ্গ করেন ‘জনপ্রিয়তা’ বলে। তাদেরকে বলি, একটা ‘হিমু’ সৃষ্টি করেন তো, দেখি কেমন পারেন। কল্পিত একটি চরিত্র, সবাই জানে যার বাস্তব রূপ প্রায় অসম্ভব, তবুও অনেকেই ‘হিমু’ হতে চায়। অনেকে কেন এই ঊনপঞ্চাশ বয়ে চলা আমিও চাই।
মানুষকে ‘মহাপুরুষ’ হতে প্রলুব্ধ করা যেনতেন কথা নয়। নিজেকে নিরাসক্ত রেখে অন্যের মঙ্গলে ‘হিমু’ হতে পথে নামানোও কোনো সহজ বিষয় নয়। এটা সবাই পারেন না, কেউ কেউ এটা পারার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। একজন লেখকের সৃষ্ট সম্পূর্ণ একটি কল্পিত চরিত্র এমন ‘আইডল’ হয়েছে; পোশাকে-পরিচ্ছেদে, চলাফেরায়, আচার-আচরণে এমন ‘হিমু’ প্রচেষ্টার আরেকটা উদাহরণ দেখান তো। এই উপমহাদেশে অনেক বড় লেখক রয়েছেন, অনেকের নাম এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে পারবেন, কিন্তু আরেকটা ‘হিমু’র নাম বলুন তো, পারবেন? দেখাতে পারবেন হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে ‘হিমু’দের?
হুমায়ূন আহমেদ গত হয়েছেন, কিন্তু বিগত হননি। হবেও না সহসাই। এতদিন পরেও মানুষ হিমু হতে যায়, আমি ঊনপঞ্চাশেও, অন্যরা ঊনিশে। মানুষের মনে এই যে ‘হিমু’ হওয়ার বাসনা একে আপনি ছোট করে ভাববেন কী ভাবে? কেন ভাববেন! ‘হিমু’ হলো সেই মানুষ, যে মানুষের ভেতরে ‘আলোকিত সত্ত্বা’, পুরুষের ভেতর ‘মহাপুরুষ’। একটি কল্পিত চরিত্রকে ঘিরে মানুষের ভেতরের সেই আলোকিত সত্ত্বা, সুপ্ত মহাপুরুষ যদি বাইরে আসতে চায়, তাহলে তো চারিপাশ আলোকিত হয়ে উঠবে, সব কিছুই ‘মহীয়ান’ হয়ে উঠবে। আপনি কেন সেই প্রক্রিয়াটাকে ‘ব্যাঙ্গ’তে ভঙ্গ করতে চাইছেন! আপনি কে? নিজের দিকে তাকান নিজের সৃষ্টির ক্ষমতাকে পরখ করুন। কী আছে ‘হিমু’ সৃষ্টির ক্ষমতা? জানি নেই, তাই অহেতুক বুকের ভেতর ‘আঁধার’ না পুষে ‘আলোকিত হিমু’ হবার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে পথে নামুন, ভরা পূর্ণিমায় জ্যোৎনা দেখুন, সেই জ্যোৎনায় আলোকিত করুন নিজেকে।
ফুট নোট : হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে গুগলের ‘ডুডল’ করা উপলক্ষে একটি লেখা ছিল আমার, প্রকাশিত হয়েছিল একটি পাঠক প্রিয় নিউজ পোর্টালে। এর আগেও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার কটি প্রকাশিত লেখা ছিল। এতেই কোনো কোনো বিখ্যাত বা বিখ্যাত হওয়ার নানাবিধ চেষ্টারত লোকজনের চোখে পড়েছে। আমাকে বলা হয়েছে যা না বুঝি, তা নিয়ে লেখা লিখি না করতে।
সত্যিই তো সাহিত্যের মতন একটি বিশাল ব্যাপার বোঝা কী আমার ক্ষুদ্র সাধ্যে সম্ভব! এই সত্যিটা স্বীকার করি, নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নেই। মনের গহীনে থাকা ‘হিমু’ই এই সত্য স্বীকারে এবং মেনে নিতে সাহস যোগায়। তবে চেষ্টা করি, যেমন ‘হিমু’ মহাপুরুষ হওয়া সম্ভব নয় জেনেও ‘পুরুষে’র কাজ করে যায়। ‘মহাপুরুষ’ না হতে পারি ‘পুরুষ’ তথা মানুষ তো হওয়া যায়। সেই মানুষ হওয়ার চেষ্টাতেই লেখা লিখি। কিছু ক্ষেত্রে রফিক আজাদের ভাষায়, লাথির বিকল্পে লেখা।
পুনশ্চ : ‘কুবের’ চরিত্রের সাথে ‘হিমু’র তুলনাকেও অনেকে ধৃষ্ঠতা ভাববেন। ভাবুন অসুবিধা নেই। চিরচেনা ‘কুবের’ সবার বোধে থাকাই স্বাভাবিক, অচেনা ‘হিমু’কে চেনাটাই অস্বাভাবিক। খ্রিস্টান ধর্মে ‘পাপ স্বীকার’ বলে একটি কথা রয়েছে। হিমুকে চেনা মানে ‘পাপ স্বীকার’ করা, ‘কনফেস’ করতে কেইবা চায় বলুন! তাই ‘হিমু’কে অস্বীকার করা কিংবা ‘হিমু’র অচেনা থাকাই তো ভালো, কী বলেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
আপনার মতামত লিখুন :