শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:১৬ সকাল
আপডেট : ১৯ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:১৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্ষণ

তারেক : রাশিদা বেগমের ঘাড়ের আঁচড়ের দাগগুলো কালো, লাল রঙ ধারণ করেছে। তিনি আমাদের কাটা দাগগুলো দেখালেন। সেগুলো দেখে মনে হলো তিনি বলতে চাইছেন, ‘দেখুন, আমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার জীবন বাজি রেখে লড়েছি।’ রাশিদা বলেন, ‘আমরা সেনাবাহিনীকে গর্ত খুঁড়তে দেখেছি (গণকবর)। আমরা পাঁচজন নারী ছিলাম, আমাদের সন্তানসহ। তারা এসে আমাদের টেনে হিঁচড়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।
তারপর দরজাটি বন্ধ করে দেয়।’

সেনারা রাশিদার কোল থেকে তার ছেলে শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করে। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু চিৎকার করে যাচ্ছিলাম। আমি কাঁদছিলাম। তবুও তারা আমাদের কথা শোনেনি। তারাতো আমাদের ভাষাও বোঝে না।’ ওই সেনারা রাশিদার ওপর একটুকুও করুণা করেনি। তারা রাশিদার গলা কেটে দেয়। তার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। তাকে মারধর করে। আরো চারজন নারীর সঙ্গে তাকেও ধর্ষণ করে। একসময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাশিদা অজ্ঞান থাকা অবস্থায় সেনারা তাদের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, যাতে তিনি সেই অবস্থাতেই ঘরের ভেতর থেকে মারা যেতে পারে তারা। রাশিদা বলেন, আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় মারা গেছি। কিন্তু আমার শরীরের চামড়া পোড়া শুরু করলে আমার জ্ঞান ফিরে। উলঙ্গ ও বিচলিত অবস্থায় আগুন থেকে পালায় রাশিদা। লুকিয়ে থাকে পার্শ্ববর্তী এক মাঠে। কিন্তু, এখন তার মনে হয়, তিনি বেঁচে না থাকলেই ভালো হতো। তিনি বলেন, ‘তখন আমিও মারা গেলে ভালো হতো। আমাকে এসব জিনিস মনে করতে হতো না। আমার বাবা-মাকেও হত্যা করা হয়েছে। বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। নরমভাষী ২৫ বছর বয়সী রাশিদা, তার ওপর সেনাদের আক্রমণ, তার সন্তানহারা হওয়ার ঘটনা নিয়ে আর কিছু বলতে চাননি। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কি প্রতিশোধ নিতে চান কি না, তখন খুব দ্রুতই উত্তর দিলেন। তিনি বলেন, যেসব সামরিক সেনারা আমাদের ধর্ষণ করেছে ও পিতা-মাতাকে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি হলে আমরা শান্তি পাবো। এরপর আবার চুপ হয়ে যান রাশিদা। তার ঠোঁট কাঁপছিল, হাত কাঁপছিল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি দূরের কিছু দেখছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত ওই ঘটনার কথা ভাবতে থাকি। এটা আমার মাথা থেকে সরছেই না।’ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে এমন বহু রাশিদা অবস্থান করছেন।
আগস্টের শেষদিক থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের এই নির্মম নৃশংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। সেখানে সেনাবাহিনীর এই নিধন অভিযান দিনের পর দিন আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রগুলোর একটি হচ্ছে যৌন নির্যাতন। সরকারি সেনাদের কাছে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্যা নারী ও মেয়ে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অবশ্য সকল প্রকারের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উপরন্তু, এ সপ্তাহে এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণিত করেছে। তাদের দাবি তারা জঙ্গি হামলার জবাবে রাখাইনে অভিযান চালাচ্ছে। দেশটির সরকার রাখাইনে নিযুক্ত জেনারেল বদলি করবেন। জাতিসংঘ মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে, ‘জাতি নিধনের একটি পরিষ্কার উদাহরণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করছেন। সাহায্যকর্মীরা বলেন, ঠিক কত জন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন তা বলা কঠিন। তবে ধর্ষণের ঘটনা এতই বেশি যে, ডক্টরস উইদাউট বর্ডার (এমএসএফ) ধর্ষিতাদের সেবা করার জন্য নতুন একটি কর্মসূচি চালু করেছে। সংস্থাটির একজন সেবাকর্মী আর্লিন পিফিল শরণার্থী শিবিরে পরিচালিত সেবা কার্যক্রমের বিষয়টি প্রচার করার জন্য একটি গান ব্যবহার করছেন। তিনি একদল তরুণীকে তা শিখিয়ে দিয়েছেন। পরে তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গানের কথা এরকম- ‘যে কেউ ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ধর্ষিতা হলে মনে কোনো শান্তি থাকে না। ধর্ষণের শিকার হওয়া কোনো অপরাধ না। ধর্ষণের তিন দিনের মধ্যে ওষুধ নেয়া প্রয়োজন। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন।’

কিছু ধর্ষিতা রোহিঙ্গা নারী এখনো তাদের ওপর চালানো পাশবিকতার বিষয়ে শঙ্কিত। সেবাকর্মী পিফিল তাদের সে গল্প উদঘাটন করেন। একেক জনের থেকে নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব কাহিনী শোনেন। পিফিল বলেন, যে সব নারীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাদের কয়েকজনের কাছে আমিই প্রথম ব্যক্তি যার কাছে তারা তাদের নির্যাতনের বিষয়ে বলেছেন। এসব নারীদের খুব কম সংখ্যকই ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেন। তাদের বেঁচে থাকার ওপর নজর দিতে হয়, সন্তানদের খাবার জোগাড় করতে হয়। এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় যাতে মর্যাদার দেখা মেলে না। সিএনএনের সঙ্গে আলাপ হওয়া নির্যাতিত নারীদের কেউই চিকিৎসা সেবা পাননি। পিফিল বলেন, নিশ্চিতভাবে তারা গর্ভধারণের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। হ্যাঁ, তারা যৌন সংক্রামক বিভিন্ন রোগের বিষয়েও শঙ্কিত। কিন্তু এখন তাদের মূল চিন্তার বিষয় হলো- তারা একই কাপড়ে দিনাতিপাত করছে। তাদের মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই। চলতি মাসের শুরুতে এমএসএফ বলেছে, কয়েক ডজন নারী ধর্ষণের পর চিকিৎসা সেবা ও মানসিক সহায়তা পেয়েছেন। এসব নারীর অর্ধেকেরও বেশির বয়স ১৮ বছরের কম। পিফিল বলেন, ‘সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বিষয় হলো, ধর্ষিতা নারীরা এখনো একই স্কার্ট পরে আছে, যা পরা অবস্থায় তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা হৃদয় চূর্ণ করার মতো একটা বিষয় যে, তিন মাস পর আপনাকে সেই কাপড়টিই পড়তে হচ্ছে, যেই কাপড়টি পড়া অবস্থায় আপনাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।’

রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন ধর্ষিতা সিএনএনের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে সম্মত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আয়শা। আয়শার গ্রামে যখন সামরিক বাহিনীর আগমন ঘটে, তার স্বামী, নিজে খুন হতে পারে এই ভয়ে পালিয়ে যায়- তাকে আর তার পাঁচ সন্তানকে একা ফেলে। তার ওপর হামলাকারীদের সমপর্কে আয়শা বলেন, ‘তারা আমাকে দেখছিল। দুই জন সেনা দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। একজন ভেতরে ঢুকলো। ঢুকে আমার দিকে একটা বন্দুক তাক করলো। তিনি আরো বলেন, তারা আমার সন্তানদের বন্দুকের পেছনের অংশ দিয়ে আঘাত করছিল যাতে করে তারা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। আমার সন্তানরা পালিয়ে যায়। আমি জানিনা তারা কোথায় গেছে।’ এরপর ওই সেনারা তাদের চোখ ৩৭ বছর বয়সী আয়শার ওপর স্থির করে। তাকে ঘুষি মারতে থাকে, পেটাতে থাকে চুপচাপ সব মেনে নেয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘দুই জন দরজার সামনে ছিল। একজন আমার কাপড় ছিঁড়ে ফেলল। আমার বুকের ওপর বন্দুক ঠেকিয়ে আমাকে ধর্ষণ করলো।’ মিয়ানমার সেনাবাহিনীদের ভাষা আর রোহিঙ্গাদের ভাষা ভিন্ন। কিন্তু আয়শা ওই সেনা কি বলছিল তা ঠিকই বুঝতে পারছিলেন।

আয়শা বলেন, ‘সে বললো, আমি তোকে খুন করে ফেলবো। তুই যদি নাড়াচাড়া করিস বা চিৎকার করিস, আমি তোকে মেরে ফেলবো। এরপর ওই সেনা তার হাত দিয়ে আয়শার মুখ চেপে ধরে। আয়শা বলেন, আমার এত জঘন্য লাগছিল। সে আমার স্বামী ছিলো না। সে আমার সঙ্গে পাশবিক আচরণ করছিলো। এক বিন্দু করুণাও দেখায়নি।’ ‘এখন ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে আমার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে। তারা আমার সঙ্গে এসব কেন করলো? তারা কেন আমাকে ধর্ষণ করলো?’ কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন আয়শা। প্রশ্নগুলো করে নিজেই সেগুলোর উত্তর দিয়ে দিলেন তিনি, তারা গ্রামের আরো অনেক নারীর ওপরই এমন নির্যাতন চালিয়েছে। তারা এটিকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা এটি করেছে কারণ নইলে আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে পালাতাম না। আর তারা ভাবে, আমাদের সঙ্গে এমনটা করলেই আমরা বাধ্য হয়ে পালিয়ে যাবো।
আয়েশার ভীতি তার মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধ ও ঘৃণাবোধের জন্ম দিয়েছে। এটা শুধু তার ওপর নির্যাতনকারীদের জন্য নয়, বরং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে জবাবদিহি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে পুরো বিশ্বের ওপর তার ক্রোধ। তিনি বলেন, যেহেতু পুরো বিশ্ব দেখছে, হয়তো আমাদের জন্য কিছু ঘটতে পারে। হয়তো আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে। আশা করি সহিংসতা বন্ধ করতে এটা সাহায্য করবে। এ জন্যই আমি কথা বলছি। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য। কেউ আমাদের সাহায্য করছে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়