শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও

প্রকাশিত : ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:৪৩ সকাল
আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:৪৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সাদা-কালোয় রোহিঙ্গা সংকট

মামুন : ২০০৬ সাল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে পৃথক করে বয়ে চলেছে নাফ নদ। এটি যেন দুই দেশের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমান্ত। একপাড়ে বাংলাদেশের টেকনাফ, অন্যপাড়ে মিয়ানমারের রাখাইন। কিন্তু দুই পাড়ের জনপদের অবস্থা পুরো বিপরীত। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশের পাহাড়বেষ্টিত টেকনাফ অঞ্চলের মানুষ সুখী জীবন যাপন করলেও সুখ নেই রাখাইনের রোহিঙ্গা জনপদে।

সেখানে সীমাবদ্ধ একটি জায়গায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই এদের কারোরই। জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের ফলে বাতাসেও গুমোট ভাব। লোকালয় জুড়ে কর্দমাক্ত স্যাঁতসেতে পরিবেশ। সেখানে স্বাভাবিক জীবন যেন পরম আরাধ্য বিষয়। পাশে একটি জায়গায় বাঁশের তৈরি কাঠামোতে তাঁবু জড়িয়ে অসুস্থদের সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোধসম্পন্ন মানুষরা বুঝতে পারছিলেন পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর ও অগ্রহণযোগ্য। কোনো মানুষকেই এমন জীবনে ঠেলে দেয়া উচিত না।
১১ বছর আগে রাখাইনে দেশহীন রোহিঙ্গাদের ছবি তুলতে যাওয়ার পর আমি এমনটাই ভেবেছিলাম। যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল তারা সবাই আমাকে, জোরপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা, বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা, জোরপূর্বক ভূমি-দখল, সম্পদ লুণ্ঠন, ইচ্ছেমতো কাজ খুঁজতে বাধা, ধর্মীয় নির্যাতন ও বিভিন্ন বিষয়ে বার্মিজ কর্তৃপক্ষের ভীতি প্রদর্শনের গল্প শুনিয়েছিল।

তারা বলেছিল, মিয়ানমারের নির্যাতন ও ভীতিকর পরিবেশে থাকার চেয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়া অনেক ভালো। ২০০৬ সালে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি ছিল। বর্তমানে তা নেই। সাম্প্রতিক সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঘটনায় রাখাইনের করুণ পরিস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই দুর্দশাকে অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর বুকে নরক যন্ত্রণাও বলা হচ্ছে। অথচ রোহিঙ্গারা রাখাইনের পরিস্থিতির তুলনায় এই নরক যন্ত্রণাকেও ভালো বলছেন। রাখাইনে কতটা নির্যাতিত হলে তারা এমনটি বলতে পারেন!

অনেক বছর ধরেই নির্যাতনের কারণে রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে ২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন বিশ্ববাসীর নজরে পড়ে। ওই বছরে সংঘটিত দাঙ্গায় প্রাদেশিক রাজধানী সিত্তের উপকণ্ঠে রোহিঙ্গা বসতিগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মসজিদগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। সিত্তে, ম্রাউকসহ কয়েকটি শহর থেকে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয়। অথচ পূর্বে এই শহরগুলোতে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমরা একত্রে বসবাস করতো। ২০১২ সালের দাঙ্গার সময় সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তীব্র বর্ণবাদমূলক ও হিংসাত্মক বক্তব্য প্রচার করতে থাকেন। তারা মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। তখন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। পাশাপাশি বন্দি করা হয় অনেককে। এরপর চলতি বছরের আগস্টে সেনা অভিযানের কারণে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বার্মিজ সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থিরা কয়েকশ’ রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। ভীত ও বেপরোয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছেই। এখানে তারা রাস্তার পাশে, বনে-জঙ্গলে, অব্যবহৃত ভবনগুলোতে, মসজিদে ও পাহাড়ের ঢালে বানানো বাঁশের তৈরি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। প্রচণ্ড রোদ সহ্য করে জীবন যাপন করছে তারা। বৃষ্টির সময় অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পানিতে তাদের কুটির বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ করলে চতুর্দিক থেকে শিশুদের কান্নার শব্দ বা বয়স্কদের কাশির শব্দ পাওয়া যায়। এখানে আশ্রয় নেয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গারই বলার মতো একটি গল্প রয়েছে। তা হলো গণহত্যার গল্প, নির্যাতনের গল্প ও ধর্ষণের গল্প। বাবা, মা, দাদি, স্ত্রী বা শিশুদের এসব গল্প ভীতি ও স্বজন হারানোর বেদনায় মোড়ানো। গত ১১ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার ওপর ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে ১৩ বার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে গিয়েছি। সময়ের পরিক্রমায় আমার ডকুমেন্টারি সেখানে বছরের পর বছর চলা সহিংসতার সচিত্র বর্ণনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর পরিচালিত ‘আই বিলোং’ প্রজেক্টের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পরিচয়বিহীন মানুষের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে এই প্রজেক্ট চালু করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা। অথচ এখনো এই বিপুল সংখ্যক মানুষের দুর্দশা লাঘবে কার্যকর কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। অসহিষ্ণুতা ও জাতিগত বৈষম্যের কারণেই লম্বা সময় ধরে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। অনেকের ধারণা, চূড়ান্তভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজভূমি থেকে বিতাড়িত করা হবে।

প্রায় রোহিঙ্গাশূন্য রাখাইনের বিষয়ে আমার মনে পড়ে জাফর নামক এক রোহিঙ্গার কথা। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, যেহেতু আমাদের নাগরিকত্ব নেই, তাই আমরা পানি ছাড়া মাছের মতো- ধুকে ধুকে মরছি, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আছে। যদি আমাদের বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া হয়, তাহলে বিষয়টি এমন হবে যে- আপনি একটি মাছ ধরে, পানিতে ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা ওই মাছের মতো যুগের পর যুগ পানির বাইরে আছি, আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা মৃত্যুর প্রহর গুনছি। দুঃখজনক বিষয় হলো, সে যখন এই কথা বলেছিল, সেই সময়ের চেয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই কথা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।

(গ্রেগ কনস্টান্টিন একজন ‘ফটোগ্রাফার’। তিনি বিগত ১১ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের ছবি তুলছেন। উপরোক্ত নিবন্ধটি সমপ্রতি তার অভিজ্ঞতা নিয়ে এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ। উল্লেখ্য, সপষ্টতার খাতিরে মূল নিবন্ধ থেকে অনুবাদে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।) মানবজমিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়