শিরোনাম
◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো ◈ রেকর্ড বন্যায় প্লাবিত দুবাই, ওমানে ১৮ জনের প্রাণহানি

প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ০৮:১৫ সকাল
আপডেট : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ০৮:১৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সংসদের অর্ধেক আসন কেন নারীর জন্য নয়?

সোহরাব হাসান : জন্মের পর থেকে বাংলাদেশে মেয়েদের সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এমন কতগুলো বাধা পেরিয়ে আসতে হয়, যা ছেলেদের করতে হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই হয়তো অল্পস্বল্প বাধা আছে, বাংলাদেশে অনেক বেশি। আবার এও ঠিক, দারিদ্র্যপীড়িত দেশের নাগরিক হিসেবে ছেলেমেয়ে উভয়কে অর্থনৈতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সেখানেও বৈষম্য আছে। কোনো পরিবারে দুটি ছেলেমেয়ে থাকলে এবং একজনের উচ্চশিক্ষার প্রশ্ন এলে মা–বাবা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা থাকে না, বাবার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত) প্রথমে ছেলের কথাই ভাবেন।

আর মেয়েদের সামাজিক ও পারিবারিক বাধা তথা নিরাপত্তার সমস্যাটি যে কত প্রকট, তা প্রতিদিনের পত্রিকা খুললেই টের পাওয়া যায়। সব খবর গণমাধ্যমে আসেও না। ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ নারী ঘরেই নির্যাতনের শিকার। এটি নারীর জন্য নয়, পুরুষদের জন্যই লজ্জার। রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম—কোনোটাই পুরুষরূপী দুর্বৃত্তদের রুখতে পারছে না।

তবে আশার কথা, এসব বাধা ও বিপদ পেরিয়েও বাংলাদেশের মেয়েরা শিক্ষা, চাকরি তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের নারীদের আয় বেশি। ভারতের নারীদের চেয়ে বাংলাদেশের নারীরা ৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের নারীদের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি আয় করেন। ক্রয় সক্ষমতা অনুসারে (পিপিপি) বাংলাদেশের নারীদের গড় আয় বছরে ২ হাজার ৩৭৯ ডলার বা ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৯ টাকা। আর ভারত ও পাকিস্তানে নারীদের আয় যথাক্রমে বছরে ২ হাজার ১৮৪ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৪ টাকা এবং ১ হাজার ৪৯৮ ডলার বা ১ লাখ ২১ হাজার ৩৩৮ টাকা।

বাংলাদেশে গ্রাম থেকে উঠে আসা স্বল্পশিক্ষিত নারীরা তৈরি পোশাক খাতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাঁরা নিজের জীবনের পরিকল্পনা করতে পারছেন, নিজের খরচ মিটিয়ে মা-বাবাকেও সাহায্য করছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন নায়ক—কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক, যার ৮০ শতাংশ নারী। সাম্প্রতিক কালে কৃষিতেও উল্লেখযোগ্য হারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যে বলেছেন, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন, শিক্ষাসুবিধা, নারীশিক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে, তার পেছনেও রয়েছে নারীর অগ্রগণ্য ভূমিকা।

২.

প্রথম আলোর ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার (৪ নভেম্বর ২০১৭) প্রধান শিরোনাম ছিল ‘১০৬ উপজেলা প্রশাসন চালাচ্ছেন নারীরাই’। পূর্ণাঙ্গ ইউএনও আছেন এ রকম উপজেলার সংখ্যা ৪২৮। সে ক্ষেত্রে নারী ইউএনওর হার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। জনপ্রশাসনে নারী সচিব আছেন ১০ জন। ৬ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং ১৬ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়াও সরকারি চাকরিতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৯ সালে সরকারি চাকরিতে নারী ছিলেন ২ লাখ ২৭ হাজার ১১৪ জন। ২০১৫ সালে ওই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৪। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে সরকারি চাকরিতে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ।

দেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ জন নারী। কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টি এবং টাঙ্গাইলে ১২টি উপজেলার মধ্যে ৮টিতে ইউএনও পদে এখন নারী। ময়মনসিংহের ১৩টি উপজেলার মধ্যে নারী ইউএনও আছেন ৫টি উপজেলায়। ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর প্রথম আলোয় চমকে দেওয়ার মতো একটি খবর ছাপা হয়েছিল। সে সময় জেলার ভারপ্রাপ্ত ডিসি, এসপি, জেলা ও দায়রা জজ, সিভিল সার্জন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও মুখ্য বিচারিক হাকিম ছিলেন নারী। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, লক্ষ্মীপুর, মুন্সিগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের ডিসি নারী। সিলেট বিভাগীয় কমিশনারও নারী। নবম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে (বিজেএস) নারীর অবস্থান আরও মজবুত। কিছুদিন আগে সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ৭৯ জন, যার মধ্যে ৩৭ জন নারী। মোট পদের প্রায় অর্ধেক। মেধাতালিকায় প্রথম থেকে ষষ্ঠ স্থানও (তৃতীয় স্থানে একজন পুরুষ বাদে) তাঁদের দখলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশ পদে আসীন আছেন নারী।

কেবল সরকারি প্রশাসন নয়, গণমাধ্যম, বেসরকারি সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদেও নারীর সরব উপস্থিতি রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যেও তাঁরা ভালো করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পদও তাঁদের দখলে। তবে বাংলাদেশের নারীরা এটুকু অর্জনে সন্তুষ্ট নন। তাঁরা সব ক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখতে চান। একসময় ভাবা হতো মেয়েরা সব কাজ পারেন না। তাঁদের জন্য শিক্ষকতা, চিকিৎসা, নার্সিং, বিমানবালা কিংবা এ ধরনের কিছু পেশা নির্ধারিত ছিল। এখন আমাদের মেয়েরা বিমান চালান। সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তাঁরা।

বাছাই করা শীর্ষপদ নয়, সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিবার থেকে শুরু করে সব সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নারীর সমান হিস্যা থাকতে হবে। নারী যদি জনসংখ্যার অর্ধেক হয়ে থাকে, তাহলে জাতীয় সংসদ থেকে মন্ত্রিসভা, জনপ্রশাসন থেকে বিচারালয়; সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি সংস্থায় তাদের উপস্থিতি সমান সমান হবে না কেন? আমরা যদি প্রধানমন্ত্রী পদে নারীকে বসাতে পারি, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতার পদ যদি তাঁরা অলংকৃত করতে পারেন, তাহলে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ বাহিনীর শীর্ষপদে কেন নারীরা আসতে পারবেন না?

আমরা আশা করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগেই বাংলাদেশ একজন নারী রাষ্ট্রপতি পাবে। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা নারী, সে দেশে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসন গৌরবের নয়। আগামী জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো একটি বিষয়ে একমত হলে নারীর ক্ষমতায়নে আমরা একটি মাইলফলক রচনা করতে পারি। ৩০০ আসনের অর্ধেকে তারা নারী প্রার্থী দিক। যে দলের প্রার্থীই জয়ী হোন না কেন, জাতি দেড় শ জন নারী সাংসদ পাবে।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতায়নের জন্য ঘরে-বাইরে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সমান হিস্যা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

কেন নাহি দিবে অধিকার

হে বিধাতা?

নত করি মাথা

পথপ্রান্তে কেন রব জাগি

ক্লান্ত ধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি

দৈবাগত দিনে।

শুধু শূন্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে

সার্থকের পথ।

কেন না ছুটাব তেজে সন্ধানের রথ

দুর্ধর্ষ অশ্বেরে বাঁধি দৃঢ় বল্গাপাশে।

দুর্জয় আশ্বাসে

দুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধন

কেন নাহি করি আহরণ।

নারীকে নিজের ভাগ্য গড়ে তোলার সুযোগ করে দিতে হবে। তাঁকে বাড়তি সুযোগ দিতে হবে না। শুধু পথের বাধাটি সরিয়ে দিন।

৩.

রাস্তায় নামলে, বাস-ট্রেনে উঠলে একটি বিষয় আমাদের খুব অবাক করে। রাস্তায় ১০ জন পুরুষ থাকলে ১ জন নারী। বাসে ৩০ জন পুরুষ যাত্রী থাকলে ৩ জন বা তারও কম নারী যাত্রী। এমনকি সেই পুরুষ যাত্রীরা বাসে উঠে নারীর জন্য নির্ধারিত আসনে পা তুলে বসে থাকেন। নারী যাত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকলেও ভ্রুক্ষেপ করেন না। এই অসভ্যতা আর কত দিন দেখতে হবে? আমরা সেদিনের অপেক্ষায় আছি, কেবল ভোটের সংখ্যায় নয়, কর্মজীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের সমান উপস্থিতি থাকবে। বাসে ১৫ জন পুরুষ যাত্রী থাকলে ১৫ জন নারী যাত্রী থাকবেন। জনপ্রশাসনে ২০ জন পুরুষ সচিব থাকলে ২০ জন নারী সচিব থাকবেন। যখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না, তখন বলা হতো মেয়েরা রিপোর্টিং করতে পারেন না। বার্তা ডেস্ক বা ফিচার বিভাগই তাঁদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু অধুনা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় মাধ্যমে মেয়েরা অনেক ভালো রিপোর্টিং করছেন। কেবল ভালো নয়, ঝুঁকি নিয়ে সাহসী রিপোর্টিং করছেন।

কর্মক্ষেত্রে অধিকসংখ্যক নারী না আসার কারণ হিসেবে অনেকে নিরাপত্তার কথা বলেন। কিন্তু আমরা মনে করি, নারী যত বেশি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসবেন, তত তাঁরা নিরাপদ বোধ করবেন। ঘরে-বাইরে নারীর সমান উপস্থিতি নারী নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা শূন্যে নিয়ে আসতে না পারলেও ৯০ শতাংশ কমাবে। তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা আরও শাণিত হবে। নারী ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলে তাঁর পেশার পরিচয়ে ‘গৃহবধূ’ নামের অপমান বইতে হবে না। সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘গৃহবধূ’ হলেন, যিনি ঘরেই থাকেন এবং সংসারধর্ম পালন করেন এমন বিবাহিত নারী। পুরুষও তো সংসারধর্ম পালন করেন। কিন্তু তাঁর পেশায় ‘গৃহস্বামী’ কথা ব্যবহৃত হয় না। তাহলে শুধু নারীকে কেন এই ভূষণ দেওয়া হবে?

কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এত দিন পুরুষকুল সেটি মানেনি। তারা যুগ যুগ ধরে নারীকে বঞ্চিত রেখেছে। অপমান করেছে। এবার তাদের সবটুকু পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার পালা।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

[email protected]। প্রথম আলো

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়