শিরোনাম
◈ চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১২ ইউনিট ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ০৮:১০ সকাল
আপডেট : ১২ নভেম্বর, ২০১৭, ০৮:১০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু

মো. মাসুদ রানা : সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে ফারিহা। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় চলে আসছে সে। ফার্মগেটে একটা স্বনামধন্য কোচিংয়ে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছে। নতুন পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তার। বেশ কয়েকদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ফারিহার। ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করার পর জানতে পারল, সে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে। এখন পড়াশোনাটাও ঠিকমত করতে পারছে না। দেখতে না দেখতেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা চলে আসল। কাল তার নোবিপ্রবিতে পরীক্ষা। পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নোয়াখালীর পথে যাত্রা করল সে। সঙ্গে তার বাবা রয়েছে। মেয়ে মানুষ কি আর এতদূর একা যেতে পারে! হোটেলে সিট না পাওয়ায় ফারিহা একটা ছাত্রী হলের গণরুমের মধ্যে ফ্লোরিং করে আছে। ফারিহার বাবা থাকার জায়গা না পেয়ে হলের মসজিদে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন, সকাল ৮.৩০। হল থেকে বের হয়ে ফারিহা পরীক্ষা দিতে গেল। পরীক্ষা ভালো হয়েছে তার। কিন্তু বাইরে এসে শুনতে পারল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। তার আশার মুখে গুড়েবালি পড়ল। সেখানে চান্স পাওয়ার আশাটা তার অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষেই সে তার বাবাসহ দিনাজপুরগামী বাসের মধ্যে উঠে পড়ল। পরদিন তার হাবিপ্রবিতে পরীক্ষা আছে। সারারাত বাসের মধ্যে ১৫ ঘণ্টা জার্নি করে সে ক্যাম্পাসে চলে আসল। মাঝখানে বাসটি জ্যামে পড়েছিল। তাই ফারিহা পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা এই ভয়ে কাঁদছিল। কারণ এটাই তার শেষ ভর্তি পরীক্ষা। এখানে যদি চান্স না পায় তবে সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনোদিন পড়তে পারবে না। অবশেষে বাসের ড্রাইভার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসটি দ্রুত চালানোর পরও পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট পর মেয়েটিকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিল। দেরিতে আসায় স্যাররা পরীক্ষার হলে ঢুকতে দিচ্ছিল না তাকে। অনেক কাকুতি-মিনতি করার পর স্যারের একটু দয়া হলো। ফারিহা পরীক্ষার হলে ঢুকল। টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা বেজেই চলছে। সময় গড়িয়ে গেল। পরীক্ষা শেষ করে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ফারিহা তার বাবাকে বলল, বাবা এবার বুঝি চান্সটা আমার হয়েই যাবে, পরীক্ষা অনেক ভালো দিয়েছি। মেয়ের কথা শুনে বাবার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে যাচ্ছে। এবার বাসায় যাওয়ার পালা তাদের। বাবা ও মেয়ে একটা অটো রিকশায় উঠলেন, গন্তব্য সামনে অবস্থিত বাস টার্মিনাল। সেখানে গিয়ে তারা কাউন্টারে টিকিট কাটবেন। অটোরিকশা চলছে, কখনো জোরে কখনো বা আস্তে। হঠাত্ করে পেছন থেকে একটা বেপরোয়া বাস তাদের অটোরিকশাটিকে ধাক্কা মারল। ফারিহা অটোরিকশা থেকে ছিটকে হাইওয়ের মাঝখানে গিয়ে পড়ল। রাস্তায় দ্রুতগতিতে চলা অন্য আরেকটি মাইক্রোবাসের চাকা তার মাথার ওপর দিয়ে চোখের পলকেই চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গেই ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি থেকে সেরিব্রাম বের হয়ে গেল। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই ফারিহা তার জীবনের সব পরীক্ষা থেকে মুক্তি নিয়ে পরপারে চলে গেল। একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটল।
উপরের ঘটনাটি কল্পিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অনেক মিল রয়েছে। এ সম্পর্কিত একটা বাস্তব ঘটনা শেয়ার করি আমি। বেশ কয়েকদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে জ্যামে আটকা পড়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর করুণ চাহনি ও চোখের জল আমাকে অনেক ভাবিয়ে তুলেছে। এ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রশ্নফাঁস প্রমাণিত হওয়ার পরও সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নে নেওয়া পরীক্ষা আর বাতিল করা হয়নি। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো, গত ৫ নভেম্বর থেকে হাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। ঠাকুরগাঁও থেকে দিনাজপুর বেশিদূর না হওয়ায় নিশি নামের একটি মেয়ে তার ভাইয়ার সঙ্গে বাইকে করে হাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসছিল সেদিন। পরীক্ষা শেষে আবার সেই বাইকে করেই বাসায় ফিরছিল। পথিমধ্যে, দিনাজপুর সদরের নশিপুর নামক একটি জায়গায় তাদের বাইকটিকে পেছন থেকে একটি ট্রাক ধাক্কা মেরেছিল। মেয়েটি ও তার ভাইয়া দুজনই ছিটকে পড়েছিল। দু’জনই গুরুতর অসুস্থ। মেয়েটি হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায়। আর তার ভাইয়া এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। শেষপর্যন্ত যমরাজ হেরে যাবে নাকি জিতে যাবে তা উপরওয়ালাই ভালো জানেন।
অনেকদিন ধরে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা এক সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। গত বছরের নভেম্বর মাসে ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তাব করেন। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এতে একমত হতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পকেটে মোটা অঙ্কের টাকা ঢুকবেনা বলেই হয়ত গুচ্ছ কিংবা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কবে অ-বাণিজ্যিকে পরিণত হবে? ভর্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের কোচিং ফি, যাতায়াত ফি, থাকা-খাওয়া ফি বাবদ অনেক টাকা চলে যায়। এই অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করা সব পরিবারের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে না। মেয়ের জন্য অভিভাবকদের নির্ঘুম রাত্রি কাটাতে হয়। কিন্তু এরপরও যখন শোনা যায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তখন মনে হয়, আমাদের দেশের বড় বড় পদে থাকা মানুষগুলো এসব কচিকচি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এমনটা চলতে থাকলে আজকের প্রজন্ম আগামীতে কেমন করে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে? তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে থাকা মানুষগুলো শেখাচ্ছে কিভাবে দুর্নীতি করতে হয়, কিভাবে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে হয়। তাই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত, নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্ স্বার্থের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা। জানি এই পদ্ধতি চালু করলে প্রথম প্রথম ছোটখাটো সমস্যার উদ্ভব হবে যা পরবর্তীকালে থাকবে না। কিন্তু অন্যদিকে অনেক বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেটা করলে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে, তবে সেটা করাটাই উচিত আমাদের। শুনেছি, এ বছরও নাকি ইউজিসি ঘোষণা দিয়েছে, সামনের বছর থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু সেটা কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে? নাকি আমাদের জন্য তা স্বপ্নই থেকে যাবে?
n লেখক :শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় । ইত্তেফাক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়