মুফতি ইমরান হুসাইন : সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ মমতাময়ী; সভ্যতা, ভদ্রতায় পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সহমর্মিতায় সমৃদ্ধ একমাত্র জাতি। শ্রেণি-ভেদ ভুলে আপনজনদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে জীবনব্যবস্থা পরিচালনাকারী একমাত্র জাতিই ছিলো মানুষ। কিন্তু আজ খানিকটা পরিতাপের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, পৃথিবী যেমনিভাবে খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে, মানুষও তেমনি প্রতিযোগিতামূলক এগোচ্ছে। এ প্রযুক্তিমোড়া গতিশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে গিয়ে পেছনে ফেলে যাচ্ছে আপনজনের মতো অমূল্য সম্পদও। স্বজনহীন অগ্রগামীতা মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে অনেকটাই। বহু পথ হেঁটেও কেনো যেনো কোথাও পিছিয়ে পড়ছে আবার। কী যেনো এক বিষণ্ণ ও শূন্যতায় গুমরে ওঠে সহসা। সেটাই হচ্ছে ভালোবাসা, আপনজনের একান্ত ছোঁয়া। প্রযুক্তি আমাদেরকে সব দিতে পারলেও স্বজনদের ছোঁয়ার স্বর্গীয় স্বাদ কোনোদিন দিতে পারবে না। এ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে সমাজের উচ্চশেখরে আবিষ্কার করতে গিয়ে মানুষ আজ বেছে নিয়েছে ইটপাথরের রু²তায় ঘেরা বন্দি নরকীয় জীবন। যেখানে কেবল স্বার্থপর নির্দয়ের গুণই চর্চিত হয় দিবানিশি। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, তবু নেওয়া হয় না গ্রামে জরাজীর্ণ ছোট্ট কুটিরে থাকা বৃদ্ধা মায়ের খবর। অসুখে বাবাটা আজ মরতে বসেছে। করা হয় না তার তেমন দেখভাল। গ্রামে দরিদ্রভাই কীভাবে দিন পার করছে, ছোটবোনটির নতুন সংসার কেমন চলছে, এমন খবর নেওয়ার অনুভুতি আজ বিলুপ্ত প্রায়। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে আজ সন্তানের হাতে বাবা-মা নৃশংসভাবে নিহত হচ্ছে। বৃদ্ধ পিতামাতা বোঝা হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ধুকে ধুকে মরছে। শিল্পপতির বাবাকে আঞ্জুমানের সহায়তায় কাফন-দাফনের মতো ঘটনাও আজ অতি সাধারণ কিছু। পত্রপত্রিকা বা মিডিয়াতে চোখ বুলালে এধরনের ঘটনার যেনো অন্ত নেই। এসবের জন্য কেবল মানুষের অহংকারবোধও কার্পন্যই দায়ী। নিজে এগিয়ে গিয়ে খবর নেওয়াটাকে দুর্বলতা মনে করে।আমি কেনো তার কাছে ছোট হতে যাবো, তার প্রয়োজন হলে সে আমার কাছে আসুক। ভাবখানা এমন থাকে। অন্যদিকে মানুষ আজ খরচাপাতির ভয়ে স্বজনদের এড়িয়ে চলছে। খবর নেয় না কোনো। ভাবে যদি কিছু চেয়ে বসে! এ হীনমন্যতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না মা-বাবাসহ নিকটতম আপনজনও। অথচ ইরশাদ হচ্ছে ‘তোমরা পিতামাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করো এবং নিকটাত্মীয়, এতীম, মিসকিন, প্রতিবেশি, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাসদাসীর প্রতিও।নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না গর্বিতজনকে এবং যারা কার্পন্য করে ও অন্যকে শিক্ষা দেয়, তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ (সুরা আরাফ : ৩৬-৩৭)। বিভিন্ন হাদিসে আত্মীয়তা রক্ষায় অনেক ফজিলত এবং বিচ্ছেদে ভয়াবহ হুশিয়ারির কথা বলা হয়েছে। এক হাদিসে এসেছে ‘যদি কেউ কামনা করে যে, তার রিজিক প্রশস্ত করা হোক এবং মৃত্যু দেরিতে হোক, তাহলে সে যেনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’ (মিশকাত : ৪১৯)। অন্য হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে ‘আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ (মিশকাত : ৪১৯)। এছাড়া বহু হাদিস রয়েছে এ ব্যাপারে, যাতে সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিণতির কথা আলোচিত হয়েছে। তাই দুনিয়ায় একটু এগোতে গিয়ে এমন জঘন্য কাজে লিপ্ত না হওয়াটা সময়ের দাবি। নইলে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত বর্বাদ হয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম কওমি মাদরাসা, শিবচর, মাদারিপুর।
আপনার মতামত লিখুন :