শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:৪০ সকাল
আপডেট : ০৮ নভেম্বর, ২০১৭, ০৬:৪০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

উলটো পিঠে সোজা পথ

ডেস্ক রিপোর্ট :‘বাবারে তুই কি ভাত খেয়েছিস? এখন কি করছিস? ঠিকমতো লেখাপড়া করিস কিন্তু।’ প্রায়ই মা ফোন করে জানতে চায় এসব। অনেক সময় মাকে মিথ্যে বলে সান্ত্বনা দেই। বলি এই তো মা খেয়েছি পৃষ্ঠা ২০ কলাম ১
। ফোন রেখে হাউমাউ করে কাঁদি। মাকে কি করে বলি, মাগো তোমার ছেলের হাতে তো টাকা নেই। দুপুরে একটি শিঙ্গাড়া খেয়ে চার গ্লাস পানি খেয়েছি।

৫ টাকা গাড়ি ভাড়া লাগবে বলে হেঁটে কলেজে আসা- যাওয়া করি। মেসে থাকেন মোহাদ্দিস। পড়েন দনিয়া কলেজে। থাকেন মাতুয়াইলের একটি মেসে। ওই মেসের একটি রুমে চারটি চৌকি ফেলানো। চারজন থাকেন। এর মধ্যে দুইজন লেখাপড়া করেন। অন্য দুজন চাকরি করেন। মোহাদ্দিস দনিয়া কলেজের ইংরেজিতে অনার্স করছেন। মেসের জীবনের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বলেন, বাড়ি থেকে মাসে চার হাজার টাকা পাঠান বাবা। এ টাকা দিয়ে থাকা-খাওয়া, কলেজের বেতন সবই করতে হয়। কিন্তু এ টাকা দিয়ে কি চলা সম্ভব? অভাবি ঘরের সন্তান হিসেবে বাড়িতেও বলতে পারি না।

খেয়ে না খেয়ে ক’মাস পার করার পর আরেক স্বজনের মাধ্যমে টিউশনি নেই। এখান থেকে কিছু টাকা পাই। তাই বলে অভাব দূর হয়নি। টেনেটুনে চালিয়ে নেই। মোহাদ্দিস বলেন, মেসের জীবন যে কত কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। যারা এর সঙ্গে পরিচিত তারা ছাড়া কেউ বুঝবে না এর কষ্ট। সকালে ঘুম থেকে ওঠে রাতে থেকে যাওয়া পানি দিয়ে রাখা ভাত কাঁচামরিচ কিংবা পিয়াজ দিয়ে চাবিয়ে কলেজে যাই। বিকালে কলেজ থেকে এসে ভাত আর আলু এক পাতিলে সিদ্ধ বসাই। আলু সিদ্ধ হয়ে গেলে তা উঠিয়ে পরে মার ফেলি। এরপর ওই আলু লবণ দিয়ে মেখে ভর্তা বানাই। তা দিয়ে ভাত খাই। মাঝে মাঝে একটি ডিমও এভাবে সিদ্ধ করে ভাত দিয়ে খেয়ে নেই। তেল, মরিচ, মসলা কিনলে টাকার দরকার। সেই টাকা কোথায়?

তাই এ খাওয়াই ছিল নিত্যদিনের। মাঝে মাঝে ডাল রান্না করে খাওয়া হতো। আর পকেটে টাকা না থাকলে কোনো হোটেলে গিয়ে একটি শিঙ্গাড়া খেয়ে চার গ্লাস পানি খেয়ে নিতাম। কাউকে বুঝতে দিতাম না মনের কষ্ট। এভাবেই অনার্স পাস করি। এই অনার্স পরীক্ষাও আমার দেয়া হতো না। নির্দিষ্ট সময়ে অর্থের অভাবে ফরম ফিলাম করতে পারিনি। অধ্যক্ষ বলেছেন, ফরম ফিলাপের টাকাসহ বকেয়া সর্বমোট ২৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। সেই টাকা নির্দিষ্ট সময়ে জোগাড় করতে পারিনি। ফরম ফিলাপও হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ের পরে এক বড় ভাইকে নিয়ে কলেজে যাই। তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভার অফ করে দেয়। ছুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ফরম ফিলাম করি। টাকা বাড়ি থেকে সুদে এনে ফরম ফিলাম করি। এ কথা জীবনে কোনোদিন ভুলবো না। আমি প্রথম বিভাগে ইংরেজিতে অনার্স পাস করি।

এখন মাস্টার্স পড়ছি। মেসের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মোহাদ্দিস জানান, অনেক সময় ঠিকমতো লেখাপড়াও করতে পারতাম না। কারণ রুমমেটের মেহমান এসেছে। ওরা বসে গল্প করছে। কিছু বলার নেই। কারণ রুমমেটও টাকা দিয়ে থাকেন। কতদিন যে না খেয়ে থেকেছি এর ইয়াত্তা নেই। আমার মতো এমন অনেক ছাত্র, চাকরিজীবী আছেন তাদের জীবনের কাহিনী শুনলে চোখ দিয়ে রক্ত বেরুবে। তারপরও আমরা একটা আশায় থাকি। লেখাপড়া শেষে একটা ভালো চাকরি পাবো। এখনকার দুঃখ তখন আর থাকবে না। মা-বাবাকেও হাসি খুশিতে রাখতে পারবো। কিন্তু ক’জন পারছে এ আশা পূরণ করতে। লেখাপড়া শেষ করে শত শত বেকার যুবক রাজধানীতে ঘুরছে চাকরির আশায়। একটি চাকরি হলে তাদের পরিবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয় না। শুধু মেসেই নয়, রাজধানীতে লজিং থেকে লেখাপড়া করেন অনেকে। পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার বিনিময়ে থাকা-খাওয়া। লজিং থাকা যে আরো কত কষ্টের তা নূর ইসলামের কথাতেই বোঝা যায়। নূর ইসলাম বর্তমানে চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ভালোভাবেই স্ত্রী- সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন। কিন্তু এখনো নূর ইসলাম লজিং বাড়ির কিছু ঘটনা ভুলতে পারেন না। তিনি লজিং থাকতেন রাজধানীর ধোলাইরপাড় এলাকায়। এক ব্যবসায়ীর তিন সন্তানকে পড়ানোর দায়িত্ব তার। সন্ধ্যা থেকে তিন সন্তানকে নিয়ে পড়াতে বসতে হতো। নিজে এ সময়ে পড়তে পারতেন না। রাত ১০টা পর্যন্ত তাদের পড়ানোর পর খাওয়া- দাওয়া শেষে নিজে পড়া আরম্ভ করতেন। নূর ইসলাম বলেন, কোনোদিন অলস বসে থাকলেই গৃহিণী তার সন্তানদের বই দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিতেন। কখনো কখনো দিনের বেলা ঘুমিয়ে পড়লে ফ্যানের সুইচ অফ করে দিতেন। প্রচণ্ড গরমে ঘুম ভেঙে যেত। বিদ্যুৎ চলে গেছে ভেবে বসে থাকতাম। হঠাৎ দেখি ফ্যানের সুইচ অফ। সেটি অন করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। পাঁচ মিনিট পর ফের দেখি একই অবস্থা। ফ্যান চলছে না। সুইচের দিকে চেয়ে দেখি সেটি অফ করা। বুঝতে আর বাকি রইলো না। গৃহকর্ত্রী চান না আমি ঘুমাই। তাই জেগে ওঠি। প্রচণ্ড গরমে বসে থাকি। এমন হাজারো ঘটনা চোখের সামনে এখনো ভেসে বেড়ায়। লজিং বাড়ির বাজার থেকে শুরু করে সবই করতে হতো। তারপর অভাবি পিতা-মাতার আশা পূরণ করতে হবে। তাই শত কষ্ট আর যাতনা সহ্য করে লজিং থাকি। কারণ পিতা-মাতার এমন সামর্থ্য ছিল না যে তারা বাড়ি থেকে টাকা পাঠাবেন। আর আমি সেই টাকা আরাম আয়েশে খরচ করবো। রাজধানীতে পড়তে আসা ছাত্রদের চরম বেকায়দায় পড়তে হয়। প্রথমেই তাদের পড়তে হয় থাকার জায়গা নিয়ে বেকায়দায়। খুঁজতে হয় বাড়ি ভাড়া।

কিন্তু ব্যাচেলর হলে তাদের বাড়ি ভাড়া নেয়া কষ্টের। তাই খুঁজতে হয় মেস। আগে অনেক বাড়িওয়ালাই মেস ভাড়া দিতেন। কিন্তু এখন নানা ঝামেলায় মেস পাওয়া দুষ্কর। কারণ নতুন করে কেউ মেস ভাড়া দেয় না। আর পুরনো মেসগুলোও যাচাই বাছাই ছাড়া কাউকে উঠান না। ফলে মেসে উঠতেও চরম বেগ পেতে হয়। মেসের জীবন, লজিং জীবন যারা পার করেছে তাদের জীবনে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এমন অভিজ্ঞতা তাদের পথকে এগিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেন আরেক ছাত্র আবদুল লতিফ। তিনি বলেন, মেসের জীবন হলো-অঙ্কুরেই বিনাশ হওয়া এক জীবন। যে জীবনের উল্টো পিঠে রয়েছে সোজা পথ। অর্থাৎ আশার আলো। তিনি বলেন, রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার এক মেসে থাকি। পড়ি ঢাকা কলেজে। কিন্তু আমাদের বুক ফেটে যায়। তবু মুখ ফুটে না। কষ্টকে জীবন সঙ্গী করে এগিয়ে চলি। ভাবি এ সময়টুকু সাময়িক। লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি করবো। তখন ভালোভাবে চলবো। এই আশাও অনেক সময় পূরণ হয় না। তিনি বলেন, সরকারের কাছে দাবি জানাই এমন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা জায়গা করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভবন করে দেয়া। যারা লেখাপড়া করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট একটা ভাড়া দিয়ে সেখানে থাকতে পারবে। যার নাম হবে সরকারি ছাত্র মেস। এমনটা হলে যন্ত্রণা অনেকটা লাঘব হবে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শিক্ষার্থীরা এসে রাজধানীর ভালো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। মানবজমিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়