আসাদুজ্জামান সম্রাট : চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সিপিএ সম্মেলনে বিশেষ রেজুলেশন (সিদ্ধান্ত প্রস্তাব) গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিরা। প্রস্তাবটি বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন সিপিএ চেয়ারপার্সন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রবিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের বিশেষ আগ্রহের প্রেক্ষিতে সিপিএ’র পক্ষ থেকে এবিষয়ে একটি ব্রিফিং-এর আয়োজন করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এই ব্রিফিং করেন। এসময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ব্রিফিং শেষে সেখানে উপস্থিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবিষয়ে সিপিএভূক্ত দেশগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদে আলোচনা এবং মিয়ানমারের উপর কুটনৈতিক চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। এসময় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্টার-পার্লামেন্টারী ইউনিয়ন (আইপিইউ)’র মতো সিপিএ সম্মেলনে একটি রেজুলেশন গ্রহণের অনুরোধ জানান। এরপর আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ১৮টি দেশের প্রতিনিধি সিপিএ চেয়ারপার্সনের প্রস্তাব অনুযায়ী রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নিজ নিজ দেশের সংসদে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দেন। তারা বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধানের দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে সিপিএ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের রেজুলেশন গ্রহণের পক্ষে একমত প্রকাশ করেন। এসময় সিপিএ চেয়ারপার্সন প্রস্তাবটি বিবেচনার আশ্বাস দেন। তিনি বিষয়টি নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে প্রতিনিধিদের জানান।
ব্রিফিং-এ আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে কোন বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গা সংকটটি মিয়ানমারের সৃষ্টি। তাদেরকেই এই সদস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের কারণে আজ আমরা সংকটের মুখোমুখী। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে আমাদের কঠিন চাপে পড়তে হয়েছে। এই সংকট নিরসনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই।
এসময় অষ্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির এমপি মার্গারেট কোয়ার্ক রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে জানতে চান, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও চায়না কিভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর চায়না ইতোমধ্যে সহায়তা পাঠিয়েছে।
ব্রিফিং শেষে কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশের পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জোরালো ভাবে তুলে ধরেন। মালদ্বীপের স্পিকার আব্দুল্লাহ মাসেহ মোহাম্মদ বলেন, আন্তজাতিক আইন লংঘন করে এই ধরণের নির্যাতন হচ্ছে, যা জঘন্যতম মানবাধিকার লংঘন। এটা একটা গণহত্যা। এটা বন্ধ করতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সিপিএ সম্মেলনে আমাদের প্রস্তাব পাস করতে হবে।
সাইথ ওয়েলস-এর সংসদ সদস্য মো. আজগর বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটি আমি বুঝি। বাংলাদেশের উপর যে চাপ এখন চলছে সেটাও সহজে অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে সম্মেলনে একটি প্রস্তাবনা আনা হোক। কমনওয়েলথ একটি অনেক বড় প্লাটফরম। যেখান থেকে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফিরিেেয় নেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
কানাডার সিনেটর সালমা আতাউল্লাহযান বলেন, মিয়ানমানে যা হয়েছে তা, একটা একটি গণহত্যা। আমরা চাচ্ছি, এই সমস্যার সমাধান হোক। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হোক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাপক প্রশংসা করেন।
সাউথ আফ্রিকার ডেপুটি স্পিকার লেসা সেলোনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমরা আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করি। রাখাইনের ঘটনার নিন্দা জানাই। চলমান সংকট নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখার জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মালেশিয়ার সংসদ সদস্য ড. মো. হাতা রামলি বলেন, আমরা মিয়ানমারে প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারি। সেখানে আমাদের বার্তা পৌছাতে পারি। যাতে তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেন। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেন। সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধ করেন।
ক্যামেরুনের এমপি নোয়াম তেবো জন বলেন, বাংলাদেশের প্রতি আমরা আন্তরিক সহমর্মিতা জানাই। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মহানুভবতা দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই চাপ সহ্য করা কঠিন হবে। দ্রুত সংকট নিরসন হবে বলে আমি আশাকরি।
এদিকে দিনের কার্যসূচী শেষে বিআইসিসি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার ব্রিফিং-এ রোহিঙ্গাদের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক বলে অস্বীকার করলেও রোহিঙ্গারা যে সেখানে সংসদ সদস্য ছিলো তার তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছেন। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ৫ দফা প্রস্তাবের আলোকে তিনি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সিপিএ প্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি আরো বলেন, প্রতিনিধিদের সকলেই এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা রাখাইনে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তারা এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া পদক্ষেপের ভূয়শী প্রশংসা করেছেন বলে তিনি জানান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজী নাবিল বলেন, ইতোমধ্যে সিপিএ প্রতিনিধিদের অনেকেই কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তারপরও যারা ক্যাম্প পরিদর্শনে যেতে চান, তাদের জন্য জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনী ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, এই সংকট নিরসনে ইতোমধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও সে দেদশ সফর করেছেন। আমরা আশা করছি, দ্রুত এই সংকট নিরসন হবে।
আপনার মতামত লিখুন :