আশিক রহমান : রোগ নির্ণয়ের জন্য যে উন্নত প্রযুক্তি দরকার, মোটামুটিভাবে তার সবই বাংলাদেশে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সামর্থ্য স্বাস্থ্যসেবায় আছে কী বাংলাদেশের? আমি মনে করি, সেই সামর্থ্য রয়েছে- আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন অভিমত দেন বিশিষ্ট নাক, কান,গলা বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত।
তিনি বলেন, যারা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তাদের মধ্যেÑ ওয়ার্ডবয়, ট্রলিবয়, সুইপার, আয়া, বুয়া, নার্স, জুনিয়র ডাক্তার, ইন্টার্ন ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তার ও প্রফেসর তারা সবাই মিলেই হেলথ কেয়ার প্রোভাইড করছে। এই হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা যদি শৃঙ্খলার মধ্যে, নিয়মের মধ্যে থাকে, যতটুকু সময় তাদের বরাদ্দ সরকারি হাসপাতালে সেবা দেওয়ার জন্য, সেই সময়টুকু যদি তারা দেন তাহলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবার আরও উন্নতি সম্ভব।
বিশ্বের সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার তুলনামূলক পার্থক্য করতে বললে বিশিষ্ট এই চিকিৎসক বলেন, পৃথিবীর সব দেশে যেসব যন্ত্রপাতি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, একই যন্ত্রপাতি আমাদের এখানেও ব্যবহƒত হয়। তবে যে রিএজেন্টগুলো আমরা ব্যবহার করি, সেগুলো আপ টু ডেট কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিছুদিন আগে বিভিন্ন ক্লিনিকে র্যাব হানা দিয়ে আউটডেটেট, এক্সপায়ার রিএজেন্ট পেয়ে জরিমানা করেছে। আজকে থার্ড জেনারেশন যে এমআরআই চলছে, সেটি জার্মানিতে যা রয়েছে, বাংলাদেশেও তাই আছে। কিন্তু যে ব্যক্তি এমআরআই মেশিনটি চালাচ্ছেন, যে ব্যক্তি এমআরআই মেশিনের ওপর রিপোর্ট দিচ্ছেন তার দক্ষতা ও সততা দুটোই সমানভাবে প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সকল স্বাস্থ্যপরীক্ষা তার মায়ের নামে হাসাপাতালে করালেন। আমরা সেখানে ছিলাম। ছোট্ট একটি প্যাথলজিও আমরা সেখানে পেয়েছি। উনার স্বাস্থ্যে কোনো সমস্যা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখেছি। সৌভাগ্য, কোনো অসুখ খুঁজে পাইনি ওনার। এই বিশ্বাসটি নিতে হবে সবাইকে। সমাজের অনেকেই আছেন, যারা অনেক কষ্ট হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। কারণ এর বাইরে তাদের সক্ষমতা নেই। আর কিছু লোক রয়েছেন সমাজে, যাদের অনেক টাকাপয়সা। এত পয়সা তাদের, যা তারা হিসাবও করতে পারবেন না! সর্দি কিংবা একটা হাঁচি দিলেও তারা বিদেশে চলে যান। এটি হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য। রবীন্দ্রনাথের একটি কথায় আছেÑ ‘প্রাচুর্য নিষ্প্রয়োজন, সচ্ছলতা প্রয়োজন, দারিদ্র্যতা অভিশাপ।’ আমাদের সচ্ছলতা দরকার, প্রাচুর্য্যরে দরকার নেই।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং উনার ছোট বোনের গলা থেকে কাঁটা বের করেছি। কাজী জাফর মারা গেছেন, উনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও তার গলা থেকে কাঁটা বের করেছি। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বেহুঁশ করে কাঁটা বের করেছি। কিছুদিন আগে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তার ওয়াইফের চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। কইমাছ দিয়ে ভাত খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা আটকে যায় তার পঁচিশ বছরের ছেলের। সেখানকার চিকিৎসকরা তার গলার কাঁটা বের করতে পারেননি, ছেলেটি মারা যায়। প্রতি শনিবার ভারত থেকে প্রচুর লোক আমার এখানে আসেন। ভোর রাতে বর্ডার ক্রস করে কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় আসেন। তারপর বলেন, আমরা ত্রিপুরা, আসাম, আগরতলাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছি, একটু দেখে দিন, তাহলে চলে যেতে পারব। এটি একটি বিশ্বাসের জায়গা। এই জায়গাটি আমাদেরকেও তৈরি করতে হবে।
কিভাবে একজন ডাক্তার মানুষের আস্থাটি অর্জন করতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাবে ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, ডাক্তারদের দায়িত্ব হচ্ছেÑ তাদের শ্রদ্ধা বা সম্মানটি অর্জন করে নেওয়া। এটি করতে কিন্তু কিচ্ছু লাগে না। স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষটির কথাগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, তাহলে তারা অনেক খুশি হয়। তবে তার জন্য আমার ভেতরে সততা থাকতে হবে। বিবেকবুদ্ধি থাকা আবশ্যক, যেন আমি নিজেই একটি আদালত। বিনা প্রয়োজনে কাউকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলাম না, এটি একটি বিশাল বিষয়। এখন কেউ আমার কাছে ব্যথা নিয়ে আসল, তার সেই ব্যথা সারানোর চেষ্টা আমি করব। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে তা সারাতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি যদি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি, সে কালকে আর আমার কাছে আসবে না, আরেকজনের কাছে চলে যাবে। তাই আমাকে মনে রাখতে হবেÑ আমিই সব না। ঈশ্বর কিংবা দেবতাও হইনি আমি। কথাগুলো যদি আমরা স্মরণে রাখি, মানুষ আস্থা পাবে। আমরা তাদের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হবো।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার সচেতন হলে ডাক্তারদের সেবাটি নেওয়া যায়। বিএসএমএমইউতে যখন আমি ভিসি ছিলাম, আড়াইটার পর সব প্রফেসরদের কাউন্টারে বসাইনি ২শ টাকার বিনিময়ে? আমি নিজে বসেছি, তখন সবাই বসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই বলছেন, আপনারা ডাক্তাররা গ্রামে যান। গ্রামে থাকেন। গ্রামের মানুষদের সেবা দিন। এই জায়গাটিতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এতে আমরা কেউ সন্তুষ্ট নই। শুধু শেখ হাসিনাই নন, যেকোনো দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন পেশাজীবীদের কাছে কোনো আহ্বান জানান, বিবেকের তাড়নায় সেই আহ্বানে তাদের সাড়া দেওয়া উচিত। স্বাস্থ্যসেবায় বিভিন্ন অনিয়ম দূর করার জন্য সরকারি মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। যে অনিয়ম-অন্যায় করবে, তার শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। অপরদিকে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠ কাজের জন্য পুরস্কৃত করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
আপনার মতামত লিখুন :